বাংলাদেশে ইন্টারনেটের সঙ্গে পরিচয়ের গল্পটি সত্যিই অনন্য এবং নস্টালজিক।
বাংলাদেশে ইন্টারনেটের যাত্রা শুরু নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। তখনকার দিনে ইন্টারনেট সম্পর্কে মানুষের ধারণা ছিল একেবারে সামান্য, এবং সেই ধারণার অধিকাংশই বিভ্রান্তিতে ভরা। উদাহরণস্বরূপ, কেউ ই-মেইল ঠিকানা দিলে সেই সাথে পাসওয়ার্ডও দিয়ে দিতেন, যেন এটি দিয়ে কি করতে হবে বুঝতেই পারতেন না। কম্পিউটার তখনও একটি বিশেষ বস্তু ছিল, যা শুধুমাত্র বড় অফিসে বা অতি সমৃদ্ধ পরিবারেই দেখা যেত। যেসব অফিসে কম্পিউটার ছিল, তাদের ভাব ছিল অন্যরকম, এবং সেসব কম্পিউটারে কাজ করতে গেলে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে ঢুকে কাজ করতে হতো। কার্পেট বিছানো মেঝেতে জুতো খুলে প্রবেশ করতে হতো এবং কেউ সর্দি-জ্বরে ভুগলে সেই ঘরে ঢুকতেন না, যেন কম্পিউটার ভাইরাস আক্রান্ত না হয়ে যায়! সেই সময় কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে (CSE) স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনার সুযোগও নতুন ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবার কম্পিউটার স্পর্শ করার অভিজ্ঞতা ছিল এক রকম জাদুমন্ত্রের মতো। ছোট মনিটরে কয়েক লাইনের প্রোগ্রাম লিখে ডট প্রিন্টারে প্রিন্ট পেতে সময় লাগত তিন দিন। ডিস্কেট দিয়ে তথ্য আদান-প্রদান করা হতো, এবং তার ক্ষমতা ছিল মাত্র ১.৪৪ মেগাবাইট। যখন প্রথমবার Windows ৩.১ দেখা হলো, মনে হলো এক নতুন যুগে পা রাখা হয়েছে। কিন্তু তখনো ইন্টারনেট সম্পর্কে কিছু জানতাম না। ইন্টারনেটের সংস্পর্শে আসা: ১৯৯৬ সালে, শুনতে পেলাম একটি নতুন কোম্পানি ISN ইন্টারনেট সুবিধা দিচ্ছে। প্রথমবার ‘ইন্টারনেট’ শব্দটি জানা হলো এবং এর কাজ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা জন্মাল। যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করলাম, তখন আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ব্যয় কমানোর উদ্দেশ্যে আমাদের অফিসে ইন্টারনেট সংযোগ নেওয়ার চেষ্টা শুরু হলো। এর জন্য আইএসএনের নিউ ইস্কাটনস্থ অফিসে গিয়ে দেখা হলো, এবং ওখানকার কর্মীদের কথা ও কাজ দেখে হতবাক হলাম। তাদের কথায় ব্যবহৃত বেশিরভাগ শব্দ ছিল একদম অপরিচিত—”Browse,” “Download,” এসব। তবে যা কিছু শিখতে পারলাম, সেসব তথ্য নিয়ে নিজেদের অফিসে এসে ম্যানেজমেন্টকে বোঝালাম এবং অফিসে ইন্টারনেট সংযোগ নেওয়া হলো। ইন্টারনেটের সাথে সংযোগ স্থাপনের প্রক্রিয়াও ছিল বেশ জটিল। কম্পিউটারকে মডেমের সাথে সংযুক্ত করতে হতো এবং মডেমের মাধ্যমে টেলিফোন লাইনে কানেক্ট করতে হতো। কানেকশনের সময় মডেম একটি বিশেষ আওয়াজ করত, যা ইন্টারনেটের প্রাথমিক যুগের স্মৃতিতে গেঁথে গেছে। Pegasus Mail নামক একটি অফলাইন ই-মেইল ক্লায়েন্টের মাধ্যমে ই-মেইল করা হতো, যেখানে মেইল লিখে জমিয়ে রাখতাম এবং পরে সংযোগ স্থাপন করে সেগুলো পাঠাতাম। প্রথম ওয়েব ব্রাউজার এবং সার্চ ইঞ্জিনের ব্যবহার:
আমাদের প্রথম ওয়েব ব্রাউজার ছিল Netscape Navigator। তবে Internet Explorer-এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে Yahoo! এবং Lycos ছিল আমাদের প্রধান ভরসা। ইন্টারনেট তখনো ভিডিও দেখার জন্য পর্যাপ্ত উন্নত ছিল না, তবে ধীরে ধীরে ওয়েবসাইটগুলোতে ছবি যোগ হতে শুরু করে, এবং সেগুলোর লোড হতে অনেক সময় লাগত। ই-মেইল বিপ্লব ও চ্যাটিং সংস্কৃতি:হটমেইল নামে বিনামূল্যে ই-মেইল সার্ভিস আসার পরে সবাই নিজের একটি ই-মেইল ঠিকানা তৈরি করে ফেলেছিল। চেইন মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ বাড়তে থাকে, কিন্তু একই সাথে ঝগড়া ও মনোমালিন্যও শুরু হয়। পরবর্তীতে mIRC নামে একটি চ্যাট ক্লায়েন্ট আসায় এক নতুন বিপ্লব ঘটে গেল। অনেকেই mIRC-এ পরিচয়ের মাধ্যমে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করত। বাংলা ভাষায় ইন্টারনেটের যাত্রা: একদিন আমাদের সহপাঠী উত্তীয় চৌধুরী একটি বাংলা ওয়েবসাইট তৈরি করলেন। সেটি ছিল আমাদের দেখা প্রথম বাংলা লেখা সাইট। বাংলায় ইন্টারনেটের যাত্রা শুরু হয় এবং অল্প দিনের মধ্যে বেশ কয়েকটি বাংলা ব্লগ এবং ফোরাম চালু হয়। এভাবে ইন্টারনেট ধীরে ধীরে আমাদের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়। ই-মেইল, চ্যাটিং, সার্চ ইঞ্জিন, এবং অনলাইন সংবাদ আমাদের জীবনকে নতুন ভাবে রূপান্তরিত করে।